ওড়পুরে এক শরীফের ভয়ে আতঙ্কিত গ্রামের হাজার হাজার মানুষ

চাঁদপুর: নাম শরীফুল ইসলাম। তবে তিনি এলাকায় উশৃঙ্খল শরিফ নামে পরিচিত। এলাকায় গড়ে তুলেছেন ত্রাসের রাজত্ব এবং জড়িয়ে পড়েছেন নানা অপকর্মে। দলীয় পদ-পদবী না থাকলেও গত জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পরি তিনি বিএনপির নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত কর্মী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে এলাকায় ও নিজ গ্রামে প্রভাব বিস্তার করছেন।

বলছি, হাজীগঞ্জ উপজেলার কালচোঁ দক্ষিণ ইউনিয়নের ওড়পুর গ্রামের হাজী বাড়ির মৃত আবু তাহেরের ছেলে শরীফুল ইসলামের কথা। তার ভয়ঙ্কর চরিত্রের কারণে আতঙ্কিত এলাকাবাসী ও গ্রামের হাজার হাজার মানুষ।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় জসিম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে দেড় লাখ ও ভেকু জসিম নামের অপর এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩৯ হাজার টাকা আদায় করেছেন শরীফ। এলাকার আরো দুই ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি ১০ লাখ করে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি মানুষের সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া-বিবাদ করে থাকেন। কেউ প্রতিবাদ করলে কিংবা তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাকে তেড়ে আসেন এবং মারধর করেন।

কথায় কথায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মানুষকে ভয় দেখিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকেন। ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস না পেলেও সম্প্রতি ইউপি সদস্যের সাথে শরিফের বিবাদের জেরে মানুষ একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন এবং কয়েকজন ভুক্তভোগী সংবাদকর্মীদের কাছে বক্তব্য দিয়েছেন। যদিও সবারে চোখে মুখে ছিলো, ভয় ও আতঙ্কের চাপ। তবে বেশিরভাগ ব্যক্তিই নিরাপত্তাহীনতায় এবং তার ভয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ।

শরীফের আপন চাচা বয়োবৃদ্ধ জাকির হোসেন জানান, সে শুধু গায়ে পড়ে ঝগড়া-বিবাদ করে। এ পর্যন্ত আমাকে কতবার মারধর করেছে, তার হিসাব নেই। কিছুদিন আগে আমার ছেলেকে পানিয়ে চুবিয়ে (ডুবিয়ে) মারতে গেছে, কিন্তু লোকজনের কারণে মারতে পারেনি। আমরা তার কাছে অসহায়। কেউ তার ভয়ে মুখ খোলে না।

ওই এলাকার জসিম ভুইয়া জানান, সে (শরিফ) মানুষকে ধরে ধরে মারে। মানুষকে মানুষ করে না। দা, কোদাল (দেশীয় অস্ত্র) পিটায়। কেউ প্রতিবাদ করলে, তাকে আওয়ামী লীগের দালাল বলে হুমকি-ধমকি দেয়। যে প্রতিবাদ করবে কিংবা তার বিরুদ্ধে বলবে, তার নিরাপত্তা নেই।

আকবর হোসেন জানান, সে মানুষের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করে, চাঁদাবাজি করে। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে, সে তাকে একা কিংবা নিরিবিলি পেলে ধরে বসে। যার কারণে সবাই নিরাপত্তাহীনতা ভুগে। আপনাদের (সংবাদকর্মী) কাছে বক্তব্য দেওয়ার কারণে, আমিই এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছি।

পারভেজ নামের অপর এক ব্যক্তি জানান, সে ইচ্ছেকৃতভাবে মানুষের সাথে ঝগড়া লাগে। কথায় কথায় মানুষকে গালাগালি ও মারধর করে। যারা আওয়ামী করে তাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে।

বৃদ্ধ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সে ভালো লোক না। তার বিরুদ্ধে যে কথা বলবে, তাকেই সে সাইজ করে দিবে। এখন আমি আপনাদের (সংবাদকর্মী) কাছে বক্তব্য দিয়ে মনে হয় বিপদে পড়ে গেছি।

সেলিম হোসেন নামের এক ব্যক্তি জানান, শরীফ ইচ্ছেকৃতভাবে তার ১৫/২০টা গরু ছেড়ে দেয় এবং সেই গরুগুলো মানুষের গাছ-গাছালি ও ফসল খেয়ে পেলে। আমার ৩০ হাজার ক্ষতি করেছে। আমি প্রতিবাদ করায়, সে আমাকে গালাগালি করে এবং মারতে আসে। আমি তার সাথে শক্তিতে পারবো না বলে মেম্বারকে জানিয়েছি।

হাদিস নামের এক দোকানদার জানান, তার দোকানে চার বছর ধরে বাকি খাচ্ছে শরীফ। কিন্তু টাকা দেয়না। তিনি বাকি বন্ধ করে দেওয়ার কারণে শরীফ ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গালাগালি ও মারধর করতে আসেন। এসময় তিনি আরো জানান, তার ভাই পারভেজ ও চাচা মাসুদের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে শরীফ।

বৃদ্ধ আবুল বাসার ভুইয়া জানান, বিদ্যালয় মাঠে খেলার একটি বিষয় নিয়ে শরীফ গায়ে পড়ে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন এবং তাকে মারধর করার জন্য তেড়ে আসেন।

তাই, নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন এলাকার লোকজন ও গ্রামবাসী। তারা তদন্তপূর্বক শরীফের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণের দাবি জানান।

এদিকে দেড় লাখ টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে অভিযুক্ত শরীফ জানান, আওয়ামী লীগের আমলে ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হয়েছি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমার কাছ থেকে ওই সময়ে টাকা নিয়েছে, ৫ আগস্টের পর আমি আবার সেই টাকা ফেরৎ নিয়েছি। তাছাড়া ওই সময়ে আমার বাড়ি-ঘরে হামলা করে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। যারা এসব কাজ করেছে, আমি তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়েছি।

অপর অভিযোগগুলো অস্বীকার করে এবং এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলে আমার পদ নেই। তবে আমি বিএনপি করি এবং আমি প্রতিবাদী। আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করিনা। যার কারণে, কোথাও অন্যায় দেখলে আমি প্রতিবাদ করে থাকি। আমি কোন হারাম কাজের সাথে জড়িত নই (না)। তাছাড়া আমি এমনিতেই কথা বলি (কণ্ঠস্বর ছড়া)। তাই, অনেকে মনে করে আমি ঝগড়া-বিবাদ করে থাকি।

তিনি ইউপি সদস্য মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, তার সাথে আমার সমস্যা হয়েছে। এই সমস্যা কারণে সে (ইউপি সদস্য) এলাকার লোকজনকে আমার বিরুদ্ধে লাগিয়েছেন।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মামুনুর রশিদ বলেন, তার (শরীফ) বিরুদ্ধে লোকজন অহরহ অভিযোগ নিয়ে আসে। শালিসি বৈঠকের মাধ্যমে কিছু বিষয় সমাধান করে দেয়েছি, আবার কিছু করতে পারি নাই। কারণ, সে বেপরোয়া টাইপের। ডাক-দোহাই (নিষেধ কিংবা বারণ) দিলে শুনে না এবং মানে না। আর এই ডাক-দোহাইয়ের কারণে, সে আমার সাথেও বিষেধাঘার করছেন এবং আমার সাথেও খারাপ আচরন করছেন।

কালচোঁ দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা স্বপন বলেন, শরীফ উশৃঙ্খল টাইপের। দলে তার কোন পদ-পদবি নেই।

হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, কিছুদিন পূর্বে সে একটি বিষয়ে মুছলেকা দিয়ে গেছে। এখন আবার তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ শুনেছি, বিষয়গুলো আমরা তদন্ত করে দেখছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইবনে আল জায়েদ বলেন, বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ফম/এমএমএ/

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | ফোকাস মোহনা.কম