একাত্তরের ডায়েরী : সুফিয়া কামাল

এস ডি সুব্রত।। কবি ও লেখিকা সুফিয়া কামাল জন্ম গ্রহন করেন তার মামার বাড়ি বরিশালের শায়েস্তাবাদ গ্রামে ১৯১১ সালে ২০ জুন । তার পৈতৃক নিবাস ছিল কুমিল্লায়। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, লেখিকা, ও নারীবাদী লেখক।সুফিয়া কামালের শিক্ষা জীবন শুরু হয় তার গৃহে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার পক্ষে গ্রহন করা সম্ভব হয়নি। কারণ, সেই সময় বাড়ীর মেয়েদের বাহিরে যেতে দেয়া হত না। গৃহ শিক্ষা নিতে গিয়ে তাকে অনেক বাধা বিপত্তির ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে এবং স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন এবং ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন। বেগম সুফিয়া কামাল , তাঁর স্বামী ও ছেলে দেশের মধ্যেই থেকে যান মুক্তিবাহিনীকে সাহস ও শক্তি জোগানোর জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবরাখবর সরবরাহের জন্য। যুদ্ধকালীন তিনি একাত্তরের ডায়েরী নামে একটি দিনলিপি রচনা করেন । ১৯৭১ সালে লেখা সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরী ‘ দিনলিপিতে উঠে এসেছে একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কিছু ঘটনার বর্ণনা যা তখনকার আতঙ্কগ্রস্ত, বিধ্বস্ত জীবনকে উপলব্ধি করতে পাঠকদের সহায়তা করবে নিঃসন্দেহে এবং সে সময়কার একটা বাস্তব চিত্র ভেসে উঠবে পাঠকের সামনে । এ দিনলিপি লেখা প্রসঙ্গে সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন, “…..মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস আমি বারান্দায় বসে বসে দেখেছি পাকিস্তানী মিলিটারীর পদচারণা। আমার পাশের বাসায় ছিল পাকিস্তানী মিলিটারীরর ঘাঁটি। ওখানে দূরবীন চোখে পাকবাহিনীর লোক বসে থাকতো।

রাস্তার মোড়ে, উল্টো দিকের বাসায় সবখানে ওদের পাহারা ছিল….।’’ কবি সুফিয়া কামাল তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘একাত্তরের ডায়েরি’ উপন্যাসে বলেছেন — “কোথাও আর অন্য কথা নেই। মা হারা বাপ হারা সন্তান হারা মাতা পিতার নিরুদ্ধ বেদনার্ত কাহিনী। কিন্তু, তার মধ্যেও সুগভীর বিশ্বাসে কি অপরিসীম ধৈর্য্যে প্রতীক্ষা। আল্লাহ সুদিন দেবেন। সকলের মিলিত প্রার্থনায় আল্লাহ দেশের ভালো নিশ্চয়ই করবে। ৮টার সময় বোমার শব্দ হল। আজ নারায়নগঞ্জের রাস্তায় একটি দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আহা! কোন মায়ের বাছা।”১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। দুর্যোগে বিপর্যন্ত মানুষের হাতে রিলিফ সামগ্রী তুলে দিতে তিনি গিয়েছিলেন পটুয়াখালির ধানখালি চর এলাকায়। রিলিফ দিয়ে ঢাকার ফিরলেন ৮ জানুয়ারি।

জলোচ্ছ্বোসের পরে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বাঙালি নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত ১ মার্চ ১৯৭১ সালে গণপরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। ১মার্চ, সোববার রাত দশটায় কবি লিখছেন, ‘বিক্ষুদ্ধ বাংলা।’ ভুট্ট্যো সাহেব পরিষদে যোগ দিবেন না সিন্ধান্তে পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রইল। ১২টায় এ খবর প্রচারিত হওয়ায়, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। বিভিন্ন তারিখে তিনি দেশের পরিস্থিতির কথা নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের দলিল হিসেবে এই ডায়েরী নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনের চিত্র। কবি সুফিয়া কামাল নিজের স্মৃতিচারণ করে লিখে গিয়েছেন একটি দেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বর্ণনা! ডায়েরির একটি বিশেষ দিক এই যে কোন কোন তারিখে তিনি শুধু একটি কবিতা লিখেছেন। একজন কবি এভাবেই নিজের প্রকাশ ঘটান। এপ্রিল ১, বৃহস্পতিবার। রাত আটটায় তিনি লেখাটি শেষ করেছেন এভাবে—“……কারফিউ চলছে। প্লেনের আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। কাল থেকে নাকি ব্যাঙ্ক সব খোলা হবে। আট আনায় তিনটি পান কিনলাম। বাংলার ইতিহাস কে রচনা করবে….?’’ ডিসেম্বর ১৬, বৃহস্পতিবার লিখছেন, ‘আজ ১২ টায় বাংলাদেশ যুদ্ধ বিরতির পর মুক্তিফৌজ ঢাকার পথে পথে এসে আবার সোচ্চার হল ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণে। আল্লাহর কাছে শোকর।’

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭৭২২৪৮২২৪
sdsubrata2022@gmail.com

ফোকাস মোহনা.কম