শাহরাস্তি (চাঁদপুর): চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার মনিপুর গ্রামে ৩৫ বছর বয়সী ভটভটি চালক ও মাইকম্যান আলমগীর হোসেনকে ছাদের উপর এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যার ঘটনা এখন পুরো এলাকায় চাঞ্চল্যের কেন্দ্রবিন্দু। এটি কি শুধুই অবৈধ সম্পর্কের জেরে সংঘটিত পরকীয়ার বলি, নাকি অর্থ লেনদেন ও জাল টাকার জটিল ফাঁদে পূর্ব-পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড—এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে।
বাড়ির ছাদে রক্তাক্ত আলমগীর
গত সোমবার (১৭ মার্চ) রাত ৮টার দিকে স্থানীয় সৌদি প্রবাসী আবুল হোসাইন মানিকের বাড়ির ছাদে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় আলমগীরকে। তার গলায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের গভীর আঘাত। কিছু সময় নিঃশ্বাস চলছিল, তবে প্রাণে বাঁচেননি। ঘটনাস্থলে উদ্ধার হয় একটি ধারালো ছুরি, যা বাজার থেকে কিনে আনা হয়েছে বলে আটককৃতরা জানিয়েছে।
পুলিশ ইতোমধ্যে বাড়ির মালিক মানিকের স্ত্রী খোদেজা বেগম পান্না (৫০) ও কন্যা মাহমুদা আক্তার সোনিয়া (২৭)-কে আটক করে আদালতের মাধ্যমে ২ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।
পরকীয়া না পাওনা টাকা: কী ছিল মূল কারণ?
স্থানীয়দের মতে, নিহত আলমগীর ও সোনিয়ার মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক এবং অর্থ লেনদেন ছিল। বিষয়টি ঘিরে নানা গুঞ্জন রয়েছে। তবে আলমগীরের পরিবার একে স্রেফ ‘পরকীয়া’ বলে চালিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য দেখছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ, সোনিয়ার কাছে আলমগীরের ১৬ লক্ষ টাকা পাওনা ছিল। ঘটনার দিন সোনিয়া বিকেলে ৬ লক্ষ টাকা দেয়ার কথা বলে ডেকে নেয়। আলমগীর দেখে টাকা জাল এবং তা গ্রহণ না করে ফিরে আসে। সন্ধ্যায় আবারও তাকে ফোনে ডেকে নেয়া হয়। এরপরই ছাদে নির্মম হত্যাকাণ্ড।
ঘটনার নতুন মোড়: তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি ও ধস্তাধস্তি
আলমগীরের ভাই মিলন অভিযোগ করেন, এটি পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। সোনিয়ার সাথে তার মামা শ্বশুর পার্শ্ববর্তী গ্রামের তাজুল ইসলাম তপনের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। ঘটনার অল্প সময় পূর্বে আলমগীরের সাথে তার মোবাইলে কথা হয়েছে। পারিবারিক বিষয়ে কথা শেষে সে আলমগীরকে সোনিয়াদের বাড়ির দিকে যেতে দেখে। ঘটনা শুনে সে ছাদে উঠতে গিয়ে দরজা বন্ধ পায়। এরপর গাছ বেয়ে ছাদে উঠে দেখতে পায় আলমগীরের গলাকাটা ও ক্ষতবিক্ষত দেহে তখনো নিঃশ্বাস চলছে, সোনিয়া একটি গামছা দিয়ে আলমগীরের গলার কাটা স্থান ঢেকে দিচ্ছে। ওইসময় সে ছাদের উপর তপনের দুটি মোবাইল দেখতে পায় যেগুলো কেড়ে নিতে সোনিয়া তার সাথে ধ্বস্তাধস্তি শুরু করে। মিলন জানান, এ ঘটনায় সোনিয়ার সাথে অন্তত ৩ জন পুরুষ ছিলো যাদের সে ছাদের দরজা খুলে বিল্ডিংয়ের ভেতর পাঠিয়ে দেয়। এরমধ্যে তপন বিল্ডিংয়ের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। বাকি ২ যুবক বিল্ডিংয়ের ভেতর আটকা পড়লে চিতোষী এলাকা থেকে ঘটনাস্থলে আসা একদল যুবক তাদের চড় থাপ্পড় দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে কৌশলে সরিয়ে দেয়।
পরিবারের দাবি: দীর্ঘদিনের লেনদেন, বন্ধুত্বের আড়ালে ফাঁদ
আলমগীরের বোন কোহিনুর জানায়, আলমগীর এলাকার মানুষের মৃত্যু সংবাদ মাইকে প্রচার করতো যার কারনে তাকে মাইক ম্যান বলা হতো। মূলত সে একজন ভটভটি চালক ও গাছের ব্যবসায়ী। এ পর্যন্ত ৪ টি ভটভটি বিক্রি করে সোনিয়াকে টাকা দিয়েছে। এছাড়া কোহিনুরের কাছ থেকে স্বর্ণ বন্ধক দেয়া ২ লাখ টাকা এনে সোনিয়াকে দিয়েছে। কোহিনুর আক্ষেপ করে বলেন, আলমগীর তার স্ত্রীর চেয়ে সোনিয়ার কথা বেশি শুনতো, তাদের মাঝে বন্ধুত্ব ও লেনদেন ছিলো, আজ সেটাই কাল হয়েছে। সোনিয়ার বিভিন্ন অপকর্ম ও জাল টাকার ব্যবসা জেনে যাওয়ায় তার ভাইকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সে আরও জানায়, আলমগীরের হাতে অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিলো যেটা সে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
আলমগীরের স্ত্রী তাসলিমা জানান, ঘটনার দিন সোনিয়া তাদের বাড়ি আসে এবং সন্ধ্যায় ১২ লক্ষ টাকা আলমগীরকে দিবে বলে জানায়। সে আগেরদিন ৬ লক্ষ টাকা ও ঘটনার দিন ৬ লক্ষ টাকা যোগাড় করেছে বলে জানায়। বিকেলে আমি আমার স্বামীকে টাকার বিষয়ে জিগ্যেস করলে সে ৬ লক্ষ টাকা জাল ছিলো বলে সে ফেরত দিয়েছে বলে জানিয়েছে।
পরকীয়ার সাজানো নাটক নাকি বাস্তবতা?
ওই গ্রামের রবিউল হোসেন জানান, আলমগীর অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলো, লেনদেনের জেরে এ হত্যাকান্ড হয়েছে। পরকীয়ার কথা বলে মূল হত্যাকারীদের আড়াল করা হচ্ছে।
সাবেক ইউপি সদস্য আতাউর জানান, আলমগীরের ন্যায্য পাওনা টাকা ও প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে পরকীয়ার ঘটনা রটানো হচ্ছে।
এদিকে গত বুধবার বিকেলে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে একটি মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয় সেখানে পরকীয়ার ঘটনা সাজানো দাবী করে খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করা হয়েছে।
সন্দেহের তীর: অর্থ লেনদেন না অন্য কিছু?
এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এলাকায় দুভাগে বিভক্ত আলোচনা—পরকীয়ার জেরে প্রতিশোধ, নাকি অর্থনৈতিক প্রতারণা ঢাকতে চক্রান্ত? আর যারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল, বিশেষ করে মামা শ্বশুর তপন ও নিচে থাকা ছেলেদের সরিয়ে দেয়ার অভিযোগ—এগুলো কি শুধুই পার্শ্ব-ঘটনা, নাকি মামলার মূল সূত্র?
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আলমগীর একজন নিরীহ, পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। তার সাথে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন ছিল। প্রশ্ন উঠছে, এসব টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হতো? তাদের মাঝে কারা জাল টাকার সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত? আর পুলিশ কত দ্রুত এ বিষয়গুলোর সুরাহা করতে পারবে?
অভিশপ্ত ও অসামাজিক কাজের আখড়া বাড়িটি!
সরেজমিনে গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই বাড়িটি তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। মা ও মেয়ে আটক থাকায় ওই বাড়িতে বসবাসরত আবুল হোসেন মানিকের ছোট মেয়ে ও বড় মেয়ের ঘরের নাতী স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বাড়িটি অভিশপ্ত ও পাপের আখড়া জানিয়ে ওই গ্রামের ওয়াসেক বেপারি বাড়ির মোঃ আঃ মান্নান জানান, বাড়িটিতে অসামাজিক কার্যকলাপ ও জাল টাকার ব্যবসা পরিচালিত হতো।
পুলিশের ভাষ্য
শাহরাস্তি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আবুল বাসার জানান, আলমগীরকে হত্যার বিষয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মা খোদেজা বেগম ও মেয়ে মাহমুদা আক্তার সোনিয়া স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আসামীদের কাছ থেকে নিহতের ব্যবহৃত ২টি মোবাইল ফোন ও তাদের তোষকের নিচ থেকে সোনিয়ার রক্তমাখা সেলোয়ার-কামিজ উদ্ধার করা হয়েছে। আটককৃতদের ২ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন ও অন্য জড়িতকে আইনের আওতায় আনা হবে। তবে এখন পর্যন্ত জাল টাকা উদ্ধার বা এ সংক্রান্ত কোন তথ্য উদঘাটন সম্ভব হয় নি।
এই হত্যাকাণ্ড আপাতদৃষ্টিতে পরকীয়ার রোমাঞ্চকর গল্প মনে হলেও পেছনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অপরাধমূলক প্রেক্ষাপট স্পষ্ট করতে তদন্ত আরও গভীর হওয়া প্রয়োজন। নিহতের পরিবার এবং এলাকাবাসীর দাবি—হত্যার নেপথ্যের সকল চরিত্রের বিচার চাই।
প্রসঙ্গত, সোমবার (১৭ মার্চ) দিনগত রাত ৮টার দিকে ওই গ্রামের ছোলাইমান মাষ্টারের বাড়ির সৌদি প্রবাসী আবুল হোসাইন মানিকের বাড়ির ছাদে আলমগীরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আলমগীর হোসেন ওই গ্রামের নতুন বাড়ির মৃত মো. শহীদ উল্লাহর ছেলে। তিনি পেশায় ভটভটি চালক ও মাইকম্যান। এক ছেলে ও দুই কন্যা সন্তানের জনক আলমগীর। তার স্ত্রীর নাম তাছলিমা বেগম।
ওই বাড়ির শিপন এশার নামাজ আদায় করে ফেরার সময় বাড়ির ছাদে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সবাইকে জানায়। এরপর ছাদে এসে আলমগীরকে এলোপাতাড়ি জখম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তার গলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিলো।
ঘটনাস্থল থেকে একটি মাঝারি সাইজের ধারালো ছুরি পাওয়াগেছে। যেটি হাটের দিন চিতোষী বাজার থেকে মা ও মেয়ে মিলে ১ হাজার ২ শত টাকায় কিনেছেন বলে তারা জানিয়েছে।
নিহত আলমগীরের নিকটাত্মীয় মো. জাহিদ হাসান বলেন, ঘটনাস্থল থেকে মোবাইল ফোনে বিষয়টি আমাকে জানালে তাৎক্ষনিক সেখানে উপস্থিত হই এবং ৯৯৯ ফোন দিয়ে ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হয়। এরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। খবর পেয়ে বহু মানুষ সেখানে ভীড় জমায়।
ফম/এমএমএ/