আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক। হাজারো-লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে, হাজারো মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ স্বাধীন করেছি। এ স্বাধীনতা অর্জন সহজে হয় নাই। অনেক কষ্ট, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, অনেক নির্যাতন, অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বর্তমানে গর্ব সহকারে আমরা বলতে পারি আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। কিন্তু তবুও কোথাও মনের ভিতরে কিছু কষ্টের কথা জমে প্রশ্ন করে, আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন, এই মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে বর্তমান নতুন প্রজন্ম কি জানে? জানলেও তারা কতটুকু জানে? অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সাথেও তো আমার বাবা শহিদ হয়েছিলেন। তাঁর এই ত্যাগের কথা কি জানে? আমার বাবার এই আত্মত্যাগ বর্তমান সমাজসহ নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্যে আমার এই ছোট্ট প্রয়াস। নিম্নে সেই বর্ননাই তুলে ধরলাম……………………..
তৎকালীন ত্রিপুরা জেলা (পরবর্তীতে যা কুমিল্লা জেলা) যে তিনটি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল, চাঁদপুর সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। মেঘনা, ডাকাতিয়া ও ধনাগোদা নদীর কোল জুড়ে ঘন সবুজ ভূখন্ডের নাম চাঁদপুর। মেঘনা কন্যা চাঁদপুর কে নিয়ে অনেক রূপকথা কিংবা অনেক কাব্যও লেখা হয়েছে। কেউ বলেন রূপসী চাঁদপুর, কেউ বলেন ইলিশের দেশ চাঁদপুর। আবার কেউ বলেন চাঁদপুর বন্দর। চাঁদপুর নামে এ জনপদ হাজার বছরের পথ চলায় প্রত্যক্ষ করেছে প্রকৃতির নানা লীলাখেলা। ভূমিকম্প, বন্যা আর নদী ভাঙনে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে কিন্তু কোনো শক্তির দাপটের কাছে হার মানেনি চাঁদপুর।
দীর্ঘ সময়ে প্রমত্তা মেঘনা নদীর ভাঙ্গা গড়ার খেলায় এ চাঁদপুরের বিস্তির্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চাঁদপুর থানা (বর্তমানে জেলা) শহর থেকে একটি বাঁকা রাস্তা পূর্ব দিকে হাজীগঞ্জ-কচুয়া-শাহরাস্তি হয়ে জেলা শহর কুমিল্লায় গিয়ে মিশেছে। সেই চাঁদপুর-কুমিল্লা মেইন রোড থেকে একটি মেঠো পথ উত্তর পশ্চিম দিকে নেমে এঁকে বেঁকে সবুজ ফসলের মাঠের মধ্যে দিয়ে গেছে একেবারে মেঘনার পাড়ে। মেঠো পথটি পাকা না হলেও গ্রামটির পুরোটা পথ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের ডালি। ফসলের মাঠের মাঝে মধ্যে দুই একটা বাড়িতে টিনের ঘর কিংবা ছনের ঘর। তবে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। তারই পাশ দিয়ে চলে গেছে প্রমত্তা মেঘনা নদী। মেঘনা নদীর ভাঙনে গ্রামের বিস্তির্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
গ্রামটির নাম দাসাদী। পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও এখানে উন্নয়নের জোয়ার ছোঁয়নি খুব একটা। গ্রামটির চেহারা আরও ক্ষীণকায় ছিল ব্রিটিশ শাসন আমলে। গ্রামটি ছায়া ঘেরা সবুজ বন জঙ্গলে ভরা। ভোরের পাখির ডাকে গ্রামবাসীদের ঘুম ভাঙে। থানা শহর চাঁদপুর থেকে প্রায় ৩/৪ মাইল দূরে মেঘনা নদীর পাড়ে গ্রামটি। এই গ্রামেরই কৃষক ইমাম উদ্দিন গাজী। তিনি একেবারেই সাদা-মাঠা জীবনে অভ্যস্ত, সৎ আর যথেষ্ট পরিশ্রমী। অনেক চাষাবাদের জমি-জমাও আছে। সংসারে তেমন কোনো অভাব অনটন নেই। গ্রামের অন্যান্য কৃষকের তুলনায় তিনি যথেষ্ট সুধী ও স্বচ্ছল। তিনি একজন সমাজসেবক। কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি স্থানীয় সামাজিক কর্মকান্ডেও জড়িত। নিজ গ্রামবাসীদের বিপদে-আপদে সবসময় সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। এছাড়া নিজে সামান্য লেখাপড়া জানতেন। কিন্তু নিজ এলাকায় জনহিতকর সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারে উৎসাহী ছিলেন।
১৯৮৯ সালে ইমাম উদ্দিন গাজীর ঘরেই জন্ম নেয় শহীদ মোঃ ইব্রহিম বি.এ.বি.টি। ডাক নাম ইব্রাহিম। পরবর্তীতে এলাকাবাসী ডাকেন বিটি সাহেব বলে। বিটি সাহেব ছিলেন তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ। শৈশবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত চঞ্চল ও চটপটে। ছেলের স্কুলে যাওয়ার বয়স হলে ইমাম উদ্দিন গাজী ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। গ্রামের আশেপাশে কোনো ভালো স্কুল নেই। চাঁদপুর শহরে ২/৩টি স্কুল ছাড়া অন্য কোথায়ও কোন স্কুল নেই। তাই তিনি ছেলেকে স্থানীয় পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেন। শৈশবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। একবার পড়লেই সব মনে থাকে। তাই স্কুল জীবনে সবসময় ক্লাসে ফার্স্ট হতেন। পরবর্তীতে তিনি চাঁদপুর শহরের স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। পিতার অনুপ্রেরণায় আলীগড় বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং আলীগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। আন্দোলনের পাশাপাশি লেখাপড়া করে কয়েক বছরের মধ্যে সুদূর ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রথম বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে যখন নিজ এলাকায় ফিরে আসেন তখন চাঁদপুর মহকুমার বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য বাড়ীতে বহু মানুষ ভিড় করেছিল। ব্রিটিশ শাসন আমলে চাঁদপুর মহকুমার হাতেগোনা যে কয়েকজন গ্র্যাজুয়েট ছিলেন তাদের মধ্যে বিটি সাহেব ছিলেন অন্যতম।
তিনি কিছুদিন সরকারি চাকুরি নিয়ে বৃহত্তর বরিশাল জেলার ভোলায় চলে আসেন এবং সরকারি চাকুরিতে মন না বসায় তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতা করার জন্য বি.এ.বি.টি প্রশিক্ষণ নিয়ে বি.এ.বি.টি পাশ করেন। তিনি ১৯২৫ সালে পগারী খাঁন সাহেবের নাতনী আছিয়া বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছয় সন্তানের জনক। তিনি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সেন্ট গ্রেগরিও স্কুলে প্রথমে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং এই স্কুলে প্রায় দশ বছর শিক্ষকতা করেন। সেন্ট গ্রেগরিও স্কুলে শিক্ষকতার সয় তিনি একাধারে ০৬ (ছয়) বছর স্কুলের বেস্ট শিক্ষক হিসেবে পুরস্কৃত হন এবং তৎকালীন সময়ে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে বেস্ট (ভালো) শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
বিটি সাহেবের দাদা শ^শুর পগারী খাঁন ছিলেন তৎকালীন সময়ে একজন শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক। ব্রিটিশ শাসন আমলে নিজ এলাকায় অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের দুঃখ দুর্দশা দেখে তাদেরকে শিক্ষিত করার জন্য নিজ বাড়িতে প্রথমে সফরমালী জুনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীতে ওই সফরমালী জুনিয়র মাদ্রাসাটি ১৯৩৪ সালে সফরমালী হাই মাদ্রাসায় উন্নীত হলে একজন বিএবিটি পাশসহ গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকের প্রয়োজন হলে পগারী খান আরেক শিক্ষানুরাগী ইমাম উদ্দিন গাজীর সঙ্গে পরামর্শ করে নাতিন জামাই বিটি সাহেবকে (শহীদ মোঃ ইব্রাহিম বিএবিটি) নিজ এলাকাবাসীর অনুরোধে জোরপূর্বক ঢাকা সেন্ট গ্রেগরিও স্কুল থেকে সফরমালী হাই মাদ্রাসায় নিয়ে আসেন। সেই তিনি সফরমালী হাই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন এবং কিছুদিন পর সফরমালী হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকের পদটি অবসরজনিত কারণে শূন্য হলে তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে সফরমালী হাই মাদ্রাসায় শিক্ষার পাঠদানের পদ্ধতি কিছুটা পরিবর্তন করলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সফরমালী হাই মাদ্রাসার রেজাল্ট পূর্বের চেয়ে ভালো হতে থাকে এবং এই প্রতিষ্ঠানের ভালো রেজাল্টের সুনাম চাঁদপুর মহকুমায় ছড়িয়ে পড়ে। ভালো রেজাল্টের সুবাদে বিটি সাহেবের প্রচেষ্টায় সফরমালী হাই মাদ্রাসাটি ১৯৬১ সালে সফরমালী হাই স্কুলে রূপান্তরিত হলে তিনি এবারও হেডমাস্টারের পদে অধিষ্ট হন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত হেড মাস্টারের দায়িত্ব পালন করেন।
বিটি সাহেব ছোট বেলা থেকেই পিতার মতো সমাজসেবা করতে ভালোবাসতেন। স্কুলে পড়ার সময় তিনি প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় গ্রামবাসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সমাজসেবা করেন। বিশেষ করে বন্যা, মহামারীর সময় সহপাঠীদের নিয়ে নিজ গ্রামের মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াইতেন। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজদের অত্যাচার নির্যাতনে বাংলার মানুষ যখন দিশেহারে তখন তিনি নির্যাতিত, নিপিড়ীত মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা শিক্ষিত ছিল তাদেরকে সুকৌশলে ইংরেজরা প্রমোশন সহ সমাজের বিভিন্ন পদে বসিয়ে বাঙালি মুসলমানদের উপর বিভিন্ন উপায়ে অত্যাচার নির্যাতন চালাতো। সেই সময় বৃহত্তর আশিকাটি ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন যজ্ঞেশ^র বর্ধন বাবু এবং তিনি বাঙালি মুসলমানদের তার বাড়ীত কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে গেলে মাটিতে বসতে দিতেন। কিন্তু হিন্দুরা গেলে তাদেরকে চেয়ারে বসতে দিতেন। ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে তখনকার সমাজব্যবস্থায় মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে বিরাট বৈষম্য ছিল। এই বৈষম্যের জন্য বিটি সাহেবকে ভীষণ পীড়া দিত। তাই তিনি স্থির করলেন হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য আগামী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে তিনি যজ্ঞেশ^র বর্ধন বাবুর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করবেন।
দীর্ঘদিন পর আশিকাটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে একজন মুসলিম পদপ্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করায় মুসলিম ভোটারদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়। দীর্ঘদিন ধরে বারবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যজ্ঞেশ^র বর্ধন বাবুর অত্যাচার নির্যাতন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আশিকাটি ইউনিয়নের সর্বস্তরের জনগণ বিটি সাহেবকে ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে। তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যে আশিকাটি ইউনিয়নের রাস্তাÑঘাট নির্মাণ করে ব্যাপক উন্নয়ন করেন। তিনি স্কুলের হেডমাস্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপশি প্রায় একাধারে ২৫ (পঁচিশ) বছর আশিকাটি ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট/ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন পর তাঁর সময়ে আশিকাটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে অনেক রাস্তা-ঘাট নির্মিত হয়েছে যা আজও লোকমুখে শোনা যায়।
শহীদ বিটি সাহেব বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তাই তিনি স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি যেমন ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট কিংবা চেয়ারম্যান ছিলেন তেমনিভাবে তিনি কুমিল্লা জেলা বোর্ডের দীর্ঘদিন মেম্বার ছিলেন। এছাড়া তিনি অনেক বছর ধরে কুমিল্লা জেলার জুড়িবোর্ডের হাকিম ছিলেন অধ্যাবসা, কাঠের সাধনা, একনিষ্ঠতা ও সততা ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে স্থানীয় পর্যায়ে তিনি ছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্ধী নেতা। সততা, উদারতা, ন্যায়পরায়নতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সকলের কাছে প্রিয় ছিলেন। ন্যায় বিচারক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল চাঁদপুর মহকুমায় সর্বত্র। তিনি আশেপাশের কয়েক ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের জটিল বিষয় নিয়ে লোকজনের মাঝে বিবাদ হলে সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে মীমাংসা করে দিতেন। বিজ্ঞ এলাকার লোকজনের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করতেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সয় বিটি সাহেব সফরমালী হাই স্কুলের হেডমাষ্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আশিকাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই সময় তিনি চাঁদপুর মহকুমার সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। ২৫ মার্চ কালরাত্রে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে গণহত্যা চালিয়ে কয়েক লাখ নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করতে গেলে বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ব্যাপক হারে নিরীহ মানুষদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাইলে শহরের আতঙ্কগ্রস্থ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যখন গ্রামের ভিতর চলে আসে তখন বিটি সাহেব নিজ এলাকার সংগ্রাম কমিটির নিজ এলাকার সংগ্রাম কমিটির লোকজনদের নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের আশ্রয়, খাদ্য ও স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চাঁদপুরের মুক্ত অঞ্চলগুলো যখন তাদের স্তর এক কর দখল করতে থাকলে তখন নিজ এলাকার ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রথমে পাকিসআতনি হানাদার বাহিনীদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি শত্রু বাহিনীর হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য নিজ এলাকাসহ আশেপাশের এলাকার স্বাধীনতাকামী ছঅত্র-জনতাদের একত্রিত করে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এছাড়া নিজের দুই ছেলের সঙ্গে নাতিকে মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতের পলাশীর নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠান। বার বার পাকিস্তান সরকারের আদেশ অমান্য করে চাঁদপুরের শত্রু বাহিনীর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের নির্দেশে নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সফরমালী হাই স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ রেখে স্কুলের ছাত্রদের ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি সংগ্রাম কমিটির লোকজনদের নিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন, খাদ্য দ্রব্য সরবরাহসহ অর্থের ব্যবস্থা করেন।
১৫ আগস্টের মধ্যরাতে অপারেশন জ্যাকপটের অধীনে নৌ-কমান্ডো বাহিনী চাঁদপুর নৌ-বন্দরের ডাকাতিয়া নদীতে ওনার (বিটি সাহেবের) পরামর্শ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী অপারেশন পরিচালনা কর লিম্পেট মাইনের আঘাতে ৬টি জলযান গভীর পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে চাঁদপুর নৌ বন্দরকে সম্পূর্ণভাবে অচল করে দেয়। এই দুঃসাহসিক অপারেশনের পর হানাদার বাহিনী তাদের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে নৌ-কমান্ডোদের অবস্থাসহ বিটি সাহেব এর দুই ছেলে ও এক নাতি এই অপারেশনের সঙ্গে জড়িত থাকার খবর গোপনে সংগ্রহ করে ১৭ আগস্ট দুপুর ১ ঘটিকার সময় দাসাদী বিটি সাহেবের বাড়ি চারিদিক থেকে ঘেরাও করে তাঁকে তার ছেলে শাহজাহান কবিরকে ধরে হাত-পা বেধে ভীষণভাবে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। প্রায় ১ ঘণ্টা অমানুষিক নির্যাতন সত্ত্বেও নৌ-কমান্ড অপারেশনের কোনো তথ্য প্রকাশ না করায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে পুনরায় বুট জুতা দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করলে বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে টেনে হেচড় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের নৌকায় উঠিয়ে নেয় এবং বাড়ির মূল্যবান মালামাল লুট করে। পাশের গ্রামে কিছু নৌ কমান্ডোেেদর আশ্রয় স্থান কামিনী লোদের বাড়িতে থাকায় সেই বাড়িতে যাওয়ার স্বর্থে কামিনী লোদের দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে ঝর্নাকে পাট ক্ষেত থেকে আটক করে অমানসিক পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর সঙ্গে তাঁর ছেলেকেও হাত-পা বেধে ভীষন নির্যাতন করে রক্তাক্ত অবস্থায় নৌকার ভিতর তার পাশে ফেলে রেখেছে। ছেলে যে একজন নৌ-কমান্ড এখন পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তা জানতে পারেনি। তাই তিনি ছেলের জীবন নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। ছেলের আসল পরিচয় যখন তারা জানতে পারবে তখন ছেলের উপর ভীষণ নির্যাতন করে নৌ-কমান্ডোদের নাম ধামসহ নৌ-কমান্ডো অপারেশনের গোপন তথ্য জানতে চেষ্টা করবে এবং ছেলের আসল পরিচয় জানলে তারা সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে ছেলেকে মেরে ফেলবে। ছেলে যখন জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে তখন তিনি নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে ছেলেকে বাঁচানোর জন্য মনে মনে একটি পরিকল্পনা করেন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি জোরে চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন, আমাকে একটু বসাও, আমি আর ব্যাথা করতে পারতেছি না। চিৎকার শুনে রাজাকার পাহাড়ারত, পাকিস্তানি সৈন্যের অনুমতি নিয়ে ছুইয়ের ভিতর ঢুকে বিটি সাহেবকে হাত-পা বাধা অবস্থায় নৌকার সামনে পাহাড়ারত সৈন্য কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিটি সাহেব পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কামিনী লোধের বাড়িতে যাওয়ার পথে ছুইয়ের ভিতর বসে, কৌশলে ছেলের হাত-পায়ের বাধন খুলে দিয়ে দ্রুত ছেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলেন, দেশের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করে মাতৃভূমি থেকে শত্রু বাহিনীদের বিতাড়িত করে দেশ স্বাধীন করতে হবে। এছাড়া নৌ-কমান্ডো বাহিনীর অপারেশনের সিক্রিমী (গোপনীয়তা) শত্রুবাহিনী যাতে জানতে না পারে সেই জন্য তাকে এখনই নৌকা থেকে কৌশলে পালাতে হবে। ছেলে পিতাকে বলে আমি পালিয়ে গেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তোমাকে মেরে ফেলবে। আমার কথা চিন্তা করিস না, আমাকে শত্রু বাহিনী কিছুই করতে পারবে না। আমার জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব। অশ্রু জলে এক পর্যায়ে ছেলেক জোর করে পালানোর নির্দেশ দিলেন।
ছেলে পিতার নির্দেশ অনুযায়ী অশ্রুজলে পিতার পা ছুয়ে সালাম করে আল্লাহকে স্মরণ করে চলত নৌকার দ্ইু মাথায় রাইফেল নিয়ে পাহাড়ারত দুই পাকিস্তানী সৈন্যের এক সৈন্যের সঙ্গে ধস্তা-ধস্তি করে তাদেরকে পানিতে ফেলে দিয়ে নিজে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ডুব সাতার কেটে ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেতের মধ্য দিয়ে অনেক দূরে একটি জঙ্গলে এসে লুকিয়ে থাকে।
ছেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সৈন্যের সঙ্গে ধস্তা-ধস্তি করে তাদেরকে পানিতে ফেলে ডুব সাতার কেটে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিটি সাহেব নৌকার ছুইয়ের মধ্যে বসে আতঙ্কের ভেতর সময় কাটান। নিজের জীবন নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তা নেই। ছেলে এই হায়েনাদের হাত থেকে বেঁচে গেছে যেন এটাই তার সান্তনা। নৌকার ছুইয়ের ফাঁক দিয়ে বহু কষ্টে ঘাড় কাত করে হানাদার বাহিনীর প্রচন্ড গুলি বর্ষণের মধ্যে ছেলে ডুব সাতার কেটে ধান-পাট ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার চোখ জুড়ানো দৃশ্য তিনি দেখলেন প্রাণভরে এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান। একজন স্বাধীনতা প্রিয় পিতার কাছে এর চেয়ে আনন্দ আর কী হতে পারে। ছেলের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়ার অপরাধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে বিটি সাহেবকে অনেক নির্যাতন সহ গুলি করলে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তিনি চিৎকার দিয়ে বলেন হে আল্লাহ এই হায়েনাদের হাত থেকে বাংলাদেশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করো বলতে বলতে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। পরের দিন ১৮ আগস্ট বিকেল আশেপাশের কয়েক হাজার গ্রামবাসী বিটি সাহেবের মরদেহ শ্রদ্ধার সঙ্গে পারিবারিক কবরস্থানে অশ্রুজলে দাফন করেন। শহীদ বিটি সাহেব (মোঃ ইব্রাহিম বি এ বি টি) একজন তুলনাহীন সমাজসেবক, লোভ-লালসামুক্ত, সৎ, সাহসী শিক্ষিত ন্যায় বিচারক ও মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন। উনার আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
লেখক : মোঃ শাহজাহান কবীর বীর প্রতীক
১৩/১, পূর্ব মাদারটেক, সিংগাপুর রোড
বাসাবো, ঢাকা-১২১৪।
মোবাইল: ০১৩১২ ৪৬১০৫৮