
।। যুবক অনার্য ।। ‘অপ্রাপ্তির শুক্লপক্ষ’ মারিয়া তুষারের চতুর্থ কাব্যপ্রয়াস।প্রসংগত উল্লেখ করি যে মারিয়া কবিতা লিখবার পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে থাকেন।এবং প্রসংগত মনে পড়ে যায় কবি অরুণ মিত্র কথিত জাক প্রেভের সম্পর্কে বিখ্যাত সেই বাক্যটি ‘ প্রেভের বর্ণনা করেন কথার ফটোগ্রাফি দিয়ে যা চলচ্চিত্রের ধর্ম’।এ বাক্যটি উল্লেখ করা এ কারণে যে মারিয়া তুষার তার চলচ্চিত্রে দৃশ্যায়ন তথা চিত্রকল্প বা ইমেজারি নির্মাণে নান্দনিক জাক্সটাপোজ বিন্যাস্ত করতে পেরেছেন প্রমাণমাত্রায় যা উৎকৃষ্ট কবিতারও ধর্ম বা বৈশিষ্ট যেমন নাকি বব ডিলানের সংগীতে আছে কাব্যরূপময়তা।
ফিরে আসি অপ্রাপ্তির শুক্লপক্ষে।এ গ্রন্থে একটি ট্রাডিশনাল বা stereotypical ধারণাকে মারিয়ে কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছেন।ট্রাডিশনাল ধারণাটি এই- মহিলা কবিদের কবিতায় সাধারণ প্রাধান্য পায় নারীবাদ ও যৌনতা।এ ধারণাটি কতোটা সত্য বা সত্যের কাছাকাছি তা বিচারের দায়িত্ব বিজ্ঞ সমালোচকদের হাতেই তোলা থাক।আমরা দেখবো মারিয়ার কবিতা এই কন্সেপ্ট থেকে কতটা সরে এসেছে।হ্যাঁ, মারিয়ার শুক্লপক্ষের কবিতাসমূহে তিনি deal বা treat করেছেন নিঃসংগতা এলিয়েনেশন শূন্যতা বঞ্চনা বিরহ সর্বোপরি এক আধুনিক ব্যক্তিমানুষের যাপিত জীবনের অনিবার্য জটিল জঙ্গমতা নিয়ে, যে জীবনে মানুষ একক ঈশ্বরের মতোই অনির্বচনীয় একা – কেবলি একা:
চেনা পথে চলতে চলতে অচেনা বাঁক
ক্লান্ত পথিক হয়ে মন
খুঁজে নিয়েছে একাকী নির্বাসন
তবে প্রশ্ন থেকে যায় কবিতা কি হবে নারীবাদ কিংবা যৌনতা বিবর্জিত নপুংসক এবং সংঘর্ষহীন কোমল ও সরলীকৃত সমীকরণজাত কোনো শিল্প! নিশ্চয়ই নয়।Literature includes everything.কবিতায় নারীবাদ যৌনতা প্রেম কিংবা যেকোনো বিষয়বস্তুকে শিল্প করে তুলতে পারাই কবির অন্বিষ্ট।বাংলা কবিতায় নারীবাদ ও যৌনতা নিয়ে সফল কবিতার সংখ্যা খুব বেশি নয়।অনেকেই চেষ্টা করেছেন এবং করছেন।তবে যেহেতু বিষয় দুটি সুদীর্ঘ ডিসকোর্স,সংক্ষিপ্ত কলেবরে সম্ভব নয় আলোচনে উতরে যাওয়া,অগত্যা মুলতবি ঘোষনা করে মারিয়ার শস্যভান্ডারে কিছুটাতো জুমচাষ হোক:
নড়বড়ে খুঁটি গেড়ে অনিশ্চয়তার দোল খায় গৃহকোণ
চাতকের পিপাসিত হৃদয় জানে শুধু
বৃষ্টির জল কতোটা আপন।
মালার্মে বলেছিলেন শব্দই ঈশ্বর।জীবনানন্দ বললেন চিত্রকল্পই কবিতা।কিছুটা লিখে পুনরায় বললেন কবিতা অনেক রকমের।শব্দ চিত্রকল্প এবং নন্দনতত্ত্বের নানাঘাট পেরিয়ে এ কথায়ই কি চূড়ান্ত নয়- কবিতা থাকে কবিতার মধ্যে,অন্য কিছুতে নয়!যদি তাই হয় তবে মারিয়াকেও পাঠক যাচাই করে নিতে চাইবেন কবিতারই নিরিখে- সেই তো খুব স্বাভাবিক :
যদি একদিন স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছে জাগে শর্তহীন,
সেদিন শুধু জানতে চাইবো-
এতো কিছুর পরেও কেনো ভালো থাকা হলো না তোমার
সমকালীন বাংলা কবিতা ও কবি নিয়ে দু’চার কথা অপ্রাসঙ্গিক নয় বোধ করি।যেমন- এই সময়ে অর্থাৎ যে সময়ে মারিয়ার উত্থান- একবিংশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি ও দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভকালে- কবি ও কবিতা বেছে নিয়েছে ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম। সে কি ভার্চুয়াল বিস্ফোরণ! এতে কবিতার কি ক্ষতি হলো কোনো, শিল্প সাহিত্যের উঠোন জুড়ে কি উৎপাদিত হলো খরাক্রান্ত প্যানোরামা!অধিক ঝুঁকিপূর্ণ উপাধ্যায় বটে।শিল্পমাধ্যম যা-ই হোক, প্রকাশমাধ্যমও হোক না যেমন খুশি তেমন, মেনে নিতে চাই- কবিতা কেবলি ‘হয়ে উঠবার’ বিষয়। তবে কীভাবে হয়ে উঠলো তার কোনো সংজ্ঞা নেই, ছিলো না কোনোকালে।অপরিসীম কবিতা লেখা হচ্ছে প্রতিদিন।কিছু উজ্জ্বল পংক্তিও দুর্লভ নয়,তবু সমালোচনার উর্ধ্বে নয় যেমন সেকালের কবিতা,তেমনি একালের কবিতাও।সমালোচনার উর্ধ্বে নন মারিয়া তুষারও।তাই তারও রয়েছে ‘কবিতায়’ ও ‘কবিতা’র হনন ও দহন ও হনন- যন্ত্রণা :
এ শহরের কষ্টের অনুভূতি প্রকাশের অনুমতি দেয় না
রক্ত মাংসে গড়া মানুষ প্লাস্টিকের পুতুল বানিয়ে ছেড়ে দেয়
T S Eloit এর and The Individual Talent- এর কথা স্মরণে রেখেই শামসুর রাহমান আবুল হাসান সমগ্রের ভূমিকায় লিখেছিলেন- কবি ভুইঁফোড় কিছু নয়।কবিকে মাড়িয়ে আসতে হয় ভূতপূর্ব ঐতিহ্য- প্রভাবিত ডামাডোল। ‘অপ্রাপ্তির শুক্লপক্ষ’-এ উল্লেখ্য ও অনুল্লেখযোগ্য Traditional প্রভাব নিয়ে মারিয়ারও আছে individual talent এবং সে প্রমাণ কবি রেখে গেছেন কতিপয় পিংক্তিতে তার:
প্রতিনিয়ত বুকের পাঁজরে একটু একটু করে মায়া অনুভব জন্ম নিচ্ছে নীল ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাচ্ছো তুমি
আলোচ্য গ্রন্থে মারিয়া কখনো তীব্র আবেগাশ্রিত। উদাহরণ:
চার দেয়ালের সুউচ্চ প্রাসাদ আছে
কিন্তু তবু্ও আমার একটা ঘর নেই
দিনশেষে মায়া দেখানোর একটা মানুষ নেই
কখনো আবেগ সংহত।যেমন:
ঘরকুনো অন্ধকারের মধ্যে একটা ‘সাধক সময়’ বরাবরই বরাদ্দ করে একরাশ ‘জীবনবোধ’।
প্রবহমান জীবনবোধ ও যাপিত জীবনের ভাঙচুর বিস্তীর্ণ অতিবাস্তব ও পরাবাস্তব দ্বৈধতা সর্বোপরি আধুনিক মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের এক নীল ব্যারোলীন মারিয়া চিত্রিত করেছেন তার কবিতার ক্যানভাসে সহজিয়া ভঙিমায় :
একটা আস্ত জীবনের ভার বয়ে নিচ্ছি চরম অনিচ্ছায়
নিছক অসহায় মনটা খুঁজে খুঁজে হয়রান তবু পায় না ঘরের ঠিকানা
এ যাবৎ মারিয়া তুষারের প্রকাশ পেয়েছে তিনটি কবিতার বই।চতুর্থ গ্রন্থ ‘অপ্রাপ্তির শুক্লপক্ষ’ মারিয়ার অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ ছাপচিত্র।এ গ্রন্থে কবি অভিজ্ঞতার নির্যাস ঢেলে দিতে চেয়েছেন মেদহীন চিকন লিরিকে:
তবু্ও মানুষ
স্বার্থ ছেড়ে
কপটতা ভুলে
মানুষের কাছে
ফিরে যায় বার বার
পরবর্তী গ্রন্থে মারিয়া হয়ে উঠবেন ক্রম বিবর্তিত মনস্ক ও সর্বসাম্প্রতিক শব্দযোজক শব্দখোড়ক ও ইন্দ্রিয়জ শব্দচাষী- রইলো দীর্ঘ প্রত্যাশা।